মো. শাহ জালাল মিশুক:বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা অর্জনে মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া এখন বেশ চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। ইচ্ছে করলেই পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যায় না। বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এটা বেশ চ্যালেঞ্জিং। এ জন্য নানামুখি দুর্ভোগ-বিড়ম্বনা, ভোগান্তি ও মানসিক চাপের শিকার হতে হয় শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের। কারণ প্রতিবছর উচ্চমাধ্যমিক পাস করা শিক্ষার্থীর তুলনায় এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আসনসংখ্যা অনেক কম। তাই ভর্তি পরীক্ষা তথা ভর্তি প্রক্রিয়া এক সময় রূপ নেয় ভর্তিযুদ্ধে।

বাংলাদেশে সাধারণত বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুরু হয় ভর্তি পরীক্ষা। এই সময়ে ভর্তীচ্ছু শিক্ষার্থীদের আনাগোনায় মুখর হয়ে ওঠে ক্যাম্পাসগুলো। কিন্তু এবার করোনার প্রাদুর্ভাবে এখনো উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা নেওয়াই সম্ভব হয়নি। কারণ বাংলাদেশে ২০২০ সালের উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পর্যায়ে মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৯ জন। বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের প্রভাবে একসাথে এতো শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেয়া অসম্ভব হয়ে পরেছে। তাই, ইতিমধ্যে সরকারীভাবে সিদ্ধান্ত এসেছে ২০২০ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা হবে না। জেএসসি ও সমমান এবং এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফলের গড় করে এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হবে ডিসেম্বরে।

যেহেতু, বৈশ্বিক মহামারীর কারণে বিগত বছরগুলোর মধ্যে এবারই প্রথম এইচ এস সি পরীক্ষা ব্যতীত (পূর্ববর্তী মূল্যায়নে) শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেয়া হবে। তাই এবারের ভর্তি পরীক্ষা সবদিক বিবেচনায় স্মরনকালেএ চ্যালেঞ্জিং ভর্তি পরীক্ষায় রুপ নিয়েছে। অর্থাৎ, সঠিকভাবে মেধাবীদের মূল্যায়ন নাহ করতে পারলে বেশ বড় ধরনের বিপদের সম্মুক্ষীন হতে হবে, ফলশ্রুতিতে দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় বিরুপ প্রভাব ফেলবে। শিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকে যদিও বলা হয়েছে, ডিসেম্বরের মধ্যেই এইচএসসি পরীক্ষার মূল্যায়ন সম্পূর্ণ করা হবে, কিন্তু হাতে সময় একদমই কম। তাই অতিদ্রুত পুরোদমে শিক্ষা মন্ত্রনালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে সমন্বিত আলোচনার ভিত্তিতে এই স্মরনকালের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৯-২০ সেশনের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে ১২ লাখেরও কিছু বেশি শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ২০১৯ সালে পাস করা শিক্ষার্থী ছিল ৯ লাখ ৮৮ হাজার ১৭২ জন। দেশের সরকারি, বেসরকারি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজ মিলিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য আসন ছিল ১২ লাখ। তবে মূল লড়াইটা হয়েছে ৪২টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৬ হাজার আসনে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করা এবং সঠিকভাবে মূল্যায়নের মাধ্যমে প্রকৃত মেধাবীদের উচ্চশিক্ষার জন্য নির্বাচিত করা। দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার বিষয়ে কয়েক বছর ধরে আলোচনা হলেও কার্যক্ষেত্রে এর প্রয়োগ ঘটানো যায়নি। গত বছরেও প্রথমে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রকৌশলী, কৃষি, সাধারন ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এই চারধরনের বিশ্ববিদ্যালয়কে একসাথে সবাইকে নিয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হয়নি। কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পড়াশোনার ধরন আলাদা। এই কারণে হয়তো সমন্বিত পরীক্ষা নেয়া যায়নি, কিন্তু সমবৈশিষ্ট্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একত্র করে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করা গেলে বেশ সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত হতো। আসলে সমন্বিত/গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার ধারণাটি আসলে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে এবং আরো আনুষঙ্গিক কয়েকটি কারণে নেয়া হয়েছিল। একজন শিক্ষার্থী এবং তার অভিভাবক দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে এভাবে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে প্রায় সময়ই নানা বিড়ম্বনার শিকার হন। যানজট অনেক ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থীর স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে। এসব কারণে জোর দাবি ছিল সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার। মেডিকেল কলেজগুলো সমন্বিত পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নিচ্ছে। তবে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ থেকে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়েছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ও কৃষিতে প্রাধান্য থাকা ৮টি বিশ্ববিদ্যালয়। এটি একটি অগ্রগতি, কারণ গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষার একটি ধাপ অর্জিত হয়েছে এবং শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কিছুটা কমেছে।

দেশের বর্তমান করোনা পরিস্থিতির ব্যাপারে এখনো অনেক কিছুই আমাদের বেশ অজানা। তাই পূর্ববর্তী বছরগুলোর মতো আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করা এই বছর বেশ চ্যালেঞ্জিং। যদি ভর্তি পরীক্ষাকালীন সময়ে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হয়, অর্থাৎ পরীক্ষা আয়োজন করার মত অবস্থা থাকে তাহলে গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষা আয়োজন করা বেশ ভালো একটি সিদ্ধান্ত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। কারণ তাহলে প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীকে আলাদাভাবে দেশের ৪৬ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহনের জন্য দেশের ৪৬ টি স্থানে যেতে হবে নাহ। বরং গুচ্ছ পদ্ধতিতে মাত্র ৪ টি পরীক্ষায় তার কাছাকাছি কেন্দ্রে অংশ নিয়ে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে। অন্যদিকে যদি করোনা পরিস্থিতি একান্তই উন্নতি নাহ হয় তখন কিভাবে অনলাইনে উক্ত পরীক্ষায় আয়োজন করা যায় সে বিষয়ে অতিদ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সর্বোপরি, এই বছর স্মরণকালের চ্যালেঞ্জিং ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়ে অতিদ্রুত সংশ্লিষ্টদের আলোচনার ভিত্তিতে করোনা পরিস্থিতি উন্নতি হলে অথবা অবনতি হলে কিভাবে প্রকৃত মেধাবীদের বাছাই করা যাবে সে বিষয়ে পূর্নাঙ্গ সিদ্ধান্ত গ্রহন করে পদক্ষেপ নিতে হবে। যদি এই প্রচেষ্টা সফলভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে দেশের উচ্চশিক্ষাব্যবস্থায় প্রকৃত মেধাবীরা অন্তর্ভুক্ত হয়ে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে৷ নতুবা মহামারী করোনার কাছে উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষার্থীদের হেরে যেতে হবে এবং আমাদের স্বপ্নের সোনা বাংলা গড়তে চলমান উন্নয়ন কর্মকান্ড চরমভাবে বিপর্যস্ত হবে।

লেখকঃ মোঃ শাহ জালাল মিশুক,

সহকারী অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ,

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *