পশ্চিমাঞ্চল ডেস্ক: রাজধানী শহর ঢাকার ২টি প্রতিষ্ঠান ‘রিজেন্ট’ ও ‘জেকেজি’। স্বাস্থ্য সেবা খাতের ব্যক্তি মালিকানাধীন সুনামধন্য এই প্রতিষ্ঠান দু’টির প্রতারণা নিয়ে দেশব্যাপী শুরু হয়েছে তোলপাড় অবস্থা এবং একই সাথে চলছে রসালো আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। ইতিমধ্যে গ্রেফতার হয়েছে রিজেন্টের চেয়ারম্যান সাহেদ, জেকেজি’র চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী ও এমডি আরিফুল হক চৌধুরী। অভিযোগ উঠেছে, এদেরকে প্রতারণার সুযোগ করে দেয়ার নেপথ্যের কারিগর স্বাস্থ্য অধিদফতরের দায়িত্বশীলরা এখনো অধরাই রয়ে গেছেন। শুধু কি এরাই স্বাস্থ্যখাতে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে? করোনার সময়ে দেশে পিসিআর টেষ্ট কিট সরবরাহ নিয়েও চলছে এক ধরণের নৈরাজ্য। অসাধু একটি সিন্ডিকেট মহামারী করোনা দুর্যোগের সময়েও বজায় রেখেছে তাদের অতি মুনাফার চিন্তা। স্বাস্থ্য অধিদফতর ও সেন্ট্রাল মেডিকেল ষ্টোর ডিপো বা কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে এই সিন্ডিকেটটি কিট সরবরাহ করে হাতিয়ে নিয়েছে বড় অঙ্কের টাকা। এই সিন্ডিকেট প্রতিটি কিটে হাতিয়েছে ১৬শ’ ৮৮ টাকা। গণমাধ্যমের সাহসী ক’একজন সংবাদকর্মীর অনুসন্ধানে কিট সরবরাহ নিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টির এসব তথ্য ইদানিং একে একে ফাস হতে চলেছে।
প্রকাশ, কোনভাবেই থামছে না স্বাস্থ্যখাতে সিন্ডিকেটের দৌড়াত্ম্য। কিছু ক্ষেত্রে চুনোপুটিদের আইনের আওতায় আনা গেলেও স্বাস্থ্যখাতের ঠিকাদারদের মাফিয়া হিসেবে পরিচিত মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু এখনও পর্যন্ত অধরাই রয়ে গেছে। সম্প্রতি তাকে কাজ না দেয়ায় কেন্দ্রীয় ওষুধাগারের পরিচালক পদ ছাড়তে হয়েছে বলে দাবী করেছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শহিদ উল্লাহ। অথচ, বর্তমান পরিচালক অতিরিক্ত সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান দায়িত্ব গ্রহণ করে সেই বিতর্কিত ব্যক্তির একটি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দিয়েছেন। গত ৩ জুন যোগদান করে ১৫ জুন আলোচিত ওই মিঠু সিন্ডিকটকে ৩৪ কোটি ৫০ লাখ টাকার পিসিআর টেষ্ট কিট ক্রয়ের কাজ পাওয়ে দেন তিনি। মিঠুর মেসার্স জেরিন এন্টারপ্রাইজকে ২৩শ’ টাকা দরে ১ লাখ ৫০ হাজার স্যানশিওর বায়োটেক ব্র্যান্ডের টেষ্ট কিটের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। এই সময়ে আরও ৩টি প্রতিষ্ঠানকে কিট সরবরাহের কাজ দেয়া হয়। শুধু কাজ দেয়ায়ই সীমাবদ্ধ নয়; করোনার শুরু থেকে যে সব ঠিকাদার কিট সরবরাহ করেছে তারা এখনো বিল না পেলেও মিঠুকে কার্যাদেশ দেয়া বিল উত্তোলনে উঠে পড়ে লেগেছেন বর্তমান পরিচালক।
জানা যায়, গত ১৫ জুন পরিচালক আবু হেনা মোরশেদ জামান স্বাক্ষরিত কার্যপত্রে মিঠুর প্রতিষ্ঠান মেসার্স জেরিন এন্টারপ্রাইজকে দেড় লাখ পিস পিসিআর টেষ্ট কিট সরবরাহের নির্দেশ দিয়ে দেন। প্রতিটি কিটের মূল্য ধরা হয়েছে ২৩শ’ টাকা। অথচ, চীনের কিট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, বেইজিং অ্যাপলাইড বায়োলোজিক্যাল টেকনোলজী কোম্পানীর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যা স্বীকৃত একটি কিটের দাম ৫০ হাজারের ওপরে সংখ্যার জন্য ৫ ডলার। চীনের এনবাও বায়োটেকনলজী কোম্পানীর ডাব্লিউএইচও স্বীকৃত একটি কিটের দাম ৫০ হাজারের ওপরে সংখ্যার জন্য পড়ছে ৬ ডলার। একইভাবে, ডাব্লিউএইচও স্বীকৃত প্রতিটি কিট চীনের নানজিং ডিনরী মেডিকেল কোম্পানী লিমিটেড এবং পেরিননিয়াল মেডিকেল বিক্রি করছে ৬ ডলারে।
প্রতি ডলারের মূল্য ৮৫ টাকা ধরে হিসাব করলে প্রতিটি কিটের বাংলাদেশী মূল্য দাঁড়াবে সর্বোচ্চ ৫১০ টাকা। এর সঙ্গে ভ্যাট, ট্যাক্স ও বিমান ভাড়া মিলিয়ে প্রতিটি কিটে খরচ পড়বে সর্বোচ্চ আরও ১০২ টাকা। সর্বমোট খরচ দাঁড়ায় ৬১২ টাকা। অথচ, সিএমএসডি থেকে দেয়া হচ্ছে প্রতিটি কিটের বিপরীতে ২৩শ’ টাকা। সিন্ডিকেটের কবলে প্রতিটি কিট বাবদ চলে যাচ্ছে ১৬শ’ ৮৮ টাকা।
এদিকে, কিট সরবরাহের কাজ পাওয়া অন্য তিন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ওভারসিজ মার্কেটিং কর্পোরেশন-ওএমসিকে ২৩শ’ টাকা দরে ১ লাখ ৫০ হাজার টেষ্ট কিটের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে; যার মূল্য ৩৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। একইভাবে মাইশা রাও টেলসেট জেভিকে ২৩শ’ টাকা ইউনিট মূল্যে ৫০ হাজার বায়োনীর ব্র্যান্ডের টেষ্ট কিট সরবরাহের আদেশ দেয়া হয়েছে; যার মূল্য ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এছাড়া, ষ্টার্লিং মাল্টি টেকনোলজিস লিমিটেডকে ২১শ’ টাকা ইউনিট মূল্যে ২৫ হাজার এন্যাটোলিয়া ব্র্যান্ডের টেষ্ট কিটের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে; যার মূল্য ৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা। একুনে ৪টি কার্যাদেশের মোট মূল্য ৮৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন আমদানীকারক জানান, প্রতিটি কিট আমদানীতে সর্বোচ্চ সাড়ে ৬শ’ টাকা খরচ হতে পারে। কার্যতঃ এটাতো এক ধরণের পুকুর চুরি। তিনি বলেন, এই দাম করোনা শুরুর দিকে হলেও মেনে নেয়া যেতো। কারণ, তখন এই কিট পাওয়া দুষ্কর ছিল। আমদানী করাটা ছিল কঠিন কাজ। খরচ বেশী পড়তো। মূল্যও ছিল কিছুটা বেশী। বর্তমানে কিটসহ করোনা সামগ্রীর দাম কমে গেছে অনেক।
নিজের নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে ওই আমদানীকারক বলেন, একটি সিন্ডিকেট সিএমএসডি’র ঠিকাদারী নিয়ন্ত্রণ করছে। এসব ঠিকাদাররাই কার্যাদেশ পেয়েছে। এই লুটপাটের সাথে স্বাস্থ্যখাতের কে কে জড়িত সেটা খতিয়ে দেখা উচিত। কিট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের এলসি ডকুমেন্ট, কাদের মাধ্যমে এই কাজ দেয়া হলো তা অবশ্যই জাতির সামনে তুলে ধরা উচিত বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সুত্র জানায়, করোনা মোকাবেলায় দ্রুত ৪৯৮ কোটি ৫৫ লাখ ৯৮ হাজার ২শ’ টাকা অনুমোদন ও ছাড় চেয়েছেন সেন্ট্রাল মেডিকেল ষ্টোর ডিপো বা কেন্দ্রীয় ঔষধাগার। এর মধ্যে ১শ’ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। এতে পিসিআর টেষ্টের কিট বাবদ ৮৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকাও আছে।
উল্লেখ্য, গত ৫ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে লেখা এক চিঠিতে সিএমএসডি পরিচালক আবু হেনা মোরশেদ জামান এ অর্থ চেয়েছেন। যা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্যসচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব এবং স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব অবহিত আছেন বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে, এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে কিছুই জানানো হয় নি।
স্বাস্থ্য অধিদফতর ও মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দরপত্র ছাড়াই সরাসরি পণ্য ক্রয়ের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। এভাবে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অতিরিক্ত দামে কিট ক্রয় করেও সিএমএসডির পরিচালক এক চিঠিতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে জানান, করোনা মোকাবিলায় টেষ্ট কিট গুরুত্বপূর্ণ। এতদিন সিএমএসডিতে কিছু প্রতিষ্ঠান একচেটিয়া ব্যবসা করলেও তিনি যোগদানের পর তা ভেঙে দিয়েছেন বলে দাবী করেন। স্বাস্থ্য অধিদফতর ও অন্যান্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সাপ্লাই চেন অব্যাহত রাখতে প্রধামন্ত্রীর কার্যালয়ের মৌখিক নির্দেশনা ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের পরামর্শে ডিপিএম পদ্ধতিতে উল্লেখিত ৪টি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়েছে বলেও তিনি চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
সুত্র আরও জানায়, মিঠু সিন্ডিকেটকে দ্রুত টাকা পাইয়ে দিতে সিএমএসডি পরিচালক চিঠিতে উল্লেখ করেন, টেষ্ট কিট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ৮৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বিল না পেয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে এবং নতুন কিট সরবরাহ করবে না। অথচ, করোনার শুরু থেকে ওএমসি কিট সরবরাহ করলেও এখন পর্যন্ত একটি টাকাও পায় নি প্রতিষ্ঠানটি বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা জুয়েল।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল শাখার একাধিক কর্মকর্তা বলেন, যে দামে ৪টি প্রতিষ্ঠানকে টেষ্ট কিট আমদানীর কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে,Ñ বাস্তবতায় কিটের মূল্য এর চেয়ে অনেক কম। তাদের মতে, এক্ষেত্রে একচেটিয়া ব্যবসা বদলানোর কোনো ঘটনা ঘটে নি। সবচেয়ে বড় কথা হল এ কার্যাদেশে বিতর্কিত এবং সমালোচিত একটি প্রতিষ্ঠানকে বড় অঙ্কের টাকার কাজ দেয়া হয়েছে।
আলোচ্য অতি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুটি নিয়ে মন্তব্য নেওয়ার জন্যে যোগাযোগ করলে সিএমএসডির পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) আবু হেনা মোরশেদ জামান তার মোবাইল কল রিসিভ করেন নি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ বলেন, এ বিষয়ে এখনও আমাকে কিছুই জানানো হয় নি। তাই, আমি কিছুই বলতে পারছি না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *