বিশেষ প্রতিনিধ::প্রবাসীদের কষ্টার্জিত রেমিটেন্সের অর্থ দেশের শেয়ারবাজার ও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। কারণ সাম্প্রতিককালে শেয়ারবাজারের উল্লম্ফন ও সঞ্চয়পত্রের বিক্রির হার ব্যাপক হারে বেড়েছে। দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সূচক আবারো ৫ হাজার পয়েন্টে ছুঁয়েছে। পাশাপাশি বাজার মূলধনও ফের ৪ লাখ কোটি টাকার ঘরে চলে এসেছে। এর মধ্যেই রোববার প্রবাসী আয়ের টাকা পুঁজিবাজারে নিয়ে আসার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম।
বিশ্লেষকরা জানান, করোনাভাইরাস মহামারি মানুষের জীবনে নিয়ে এসেছে অর্থনৈতিক সংকট। ব্যাংকিং খাতে মুনাফার হার কম। কিন্তু করোনাকালের এই কঠিন সময়ে মানুষ টাকা পাচ্ছে কোথায়? যে কারণে শেয়ারবাজার ও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়ছে? নানা ধরনের কড়াকড়ি আরোপের পরেও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছে গ্রাহকরা।
তাদের মতে, এর দু’টি সম্ভাব্য কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের একটি অংশ দিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনছে। আগেও কিনতো, তবে এখন রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ায় এই অঙ্ক বেড়েছে। এছাড়া শেয়ারবাজারে অনেকটা আস্থা ফিরেছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। তাই সবাই এখানেই বিনিয়োগ করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে অর্থাৎ প্রথম প্রান্তিকে ৬৭১ কোটি ৩১ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৮.৫৭ শতাংশ বেশি। আলোচ্য সময়ে যে রেমিটেন্স এসেছে তা গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের মোট রেমিটেন্সের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি। গত সেপ্টেম্বর মাসে ২১৫ কোটি ১০ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিটেন্স। এর আগে এই মহামারির মধ্যেই গত জুলাই মাসে ২.৬ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স এসেছিল দেশে, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ।
এদিকে রোববার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ব্রোকার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিবিএ) আয়োজিত বিশ্ব বিনিয়োগকারী সপ্তাহের সমাপনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)-এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, উৎসাহ দিয়ে প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্সের টাকা পুঁজিবাজারে নিয়ে আসতে হবে। বিএসইসি’র চেয়ারম্যান বলেন, সব জায়গাতে আমাদের রেমিটেন্সের ছোঁয়া চলে এসেছে। রেমিটেন্সের যে টাকা দেশে আসছে তার সবগুলো কিন্তু খরচ হয় না। ব্যাংকিং সিস্টেমে অনেক লিকুইড ক্যাশ আছে। এই রেমিটেন্স যারা পাঠাচ্ছেন তাদের উৎসাহ দিয়ে আপনারা বাজারে নিয়ে আসতে পারেন। তিনি বলেন, বিদেশে যেখানে বাংলাদেশি ভাইবোনেরা আছেন, সেখানে আপনাদের ডিজিটাল আউটলেট ওপেন করেন। আপনাদের ডিজিটাল আউটলেট ওপেন করার জন্য যাবতীয় অনুমতি বা সহায়তা যতটুকু আমাদের পক্ষে সম্ভব সবটুকু আমরা করবো।
ওদিকে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা গেছে, গত জুলাই-আগস্ট সময়ে ৭ হাজার ৪৫৫ কোটি ৫ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এই অঙ্ক গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ের দ্বিগুণেরও বেশি। গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে ৩ হাজার ৭১২ কোটি ৩৬ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৩ হাজার ৫৪৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। আর আগস্টে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৭৪৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা, যা এক মাসের হিসাবে গত দেড় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১৯ সালের মার্চে ৪ হাজার ১৩০ কোটি ৭১ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। আর গত বছরের আগস্টে এই বিক্রির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪৯৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, গত বছরের আগস্টের চেয়ে এবার আগস্টে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়েছে ১৫০ শতাংশ। মুনাফার উপর করের হার বৃদ্ধি এবং নানা ধরনের কড়াকড়ি আরোপের পরেও সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ছে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের একটি অংশ দিয়ে মানুষ হয়তো সঞ্চয়পত্র কিনছে। এটি আগেও ছিল, তবে এখন রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ায় এই অঙ্ক বেড়েছে। এ ছাড়া অন্য যেকোনো সঞ্চয় প্রকল্পের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার যেহেতু বেশি, সবাই এখানেই বিনিয়োগ করছে।
ডিএসই’র এক পরিচালক বলেন, রেমিটেন্সের টাকা শেয়ারবাজারে আসার অফিসিয়াল কোনো তথ্য নেই। কারণ বাজারে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী রয়েছে। কে কোন টাকা বিনিয়োগ করছে তা জানার উপায় নাই। অবশ্য রেমিটেন্সের টাকা আগেও আসতো। তবে ইদানীং মনে হয় বেশি বেশি আসা শুরু হয়েছে। কেননা, দেশে প্রচুর পরিমাণে রেমিটেন্স আসছে। ব্যাংকেও সুদ হার কম। আবার সঞ্চয়পত্রে সুদ হার বেশি। এ ছাড়া শেয়ারবাজারও ঊর্ধ্বমুখী। তাই বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার আর সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছে বলে তার ধারণা।
বিনিয়োগকারী আতিকুল ইসলাম বলেন, আমার বাবার পাঠানো রেমিটেন্স দিয়ে ছোট ব্যবসা শুরু করি। সেটা ভালোভাবে রান করতে পারি নাই। কী করবো ভাবছিলাম। তার মতে, ব্যাংকে আমার আস্থা নাই। তাছাড়া ব্যাংকে সুদ হারও কম। তাই কিছু টাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করি। আরো কিছুদিন পরে শেয়ারবাজার চাঙ্গা থাকায় এখানেও বিনিয়োগ করি। এখন মোটামুটি ভালোই চলছে বলে জানান তিনি।