কালীগঞ্জ প্রতিনিধিঃস্থানীয় সাংসদের কারণে ঝিনাইদহের মাহতাব উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ১৪ মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগ অস্বীকার করে ঝিনাইদহ-৪ আসনের (ঝিনাইদহ সদরের আংশিক ও কালীগঞ্জ) সাংসদ আনোয়ারুল আজীম বলেছেন, অধ্যক্ষের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণেই বেতন বন্ধ। তবে শিক্ষা অধিদপ্তরের তদন্তে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা মেলেনি। অধিদপ্তর বলছে, অধ্যক্ষের কাছে দায়িত্ব ন্যস্ত করতে হবে। তাঁর স্বাক্ষর ছাড়া বেতন-ভাতা উত্তোলন করা যাবে না।
এদিকে অধ্যক্ষ দায়িত্ব না পাওয়ায় বেতন বিলে সই করতে পারছেন না। আর শিক্ষক,কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনও হচ্ছে না। অথচ বেতন বিলের প্রায় দুই কোটি টাকা এক বছর ব্যাংকে পড়ে থেকে ফেরত গেছে। করোনার এই সময়ে মাসের পর মাস বেতন না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
শিক্ষকদের অভিযোগ, কলেজের অধ্যক্ষ নিয়ে স্থানীয় রাজনীতির শিকার হচ্ছেন তাঁরা। শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে অধ্যক্ষ ড. মাহবুবুর রহমানকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। এমনকি তাঁর স্বাক্ষর ছাড়া বেতন না দিতে ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মাহবুবুর রহমান কলেজে আসতে না পারায় বেতন বিলে সই করতে পারছেন না। স্থানীয় একটি মহল তাঁকে কলেজে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না।
অধ্যক্ষ মাহবুবুর রহমানের অভিযোগ, স্থানীয় সাংসদ আনোয়ারুল আজীম কলেজের এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। তিনি বৈধ অধ্যক্ষ, তারপরও সাংসদ তাঁকে কলেজে যেতে দেন না। নিজে কয়েক দফা কলেজ থেকে বের করে দিয়েছেন তাঁকে। কারণ জানতে চাইলে অধ্যক্ষ বলেন, কলেজ সরকারি ঘোষণার পর সাংসদ অবৈধভাবে কমপক্ষে ২০ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি যোগদান করলে এগুলো বৈধ করা কষ্টকর হবে। তাই তাঁকে বসতে দেওয়া হচ্ছে না।
অভিযোগ অস্বীকার করে ঝিনাইদহ-৪ আসনের (ঝিনাইদহ সদরের আংশিক ও কালীগঞ্জ) সাংসদ মো. আনোয়ারুল আজীম বলেন, শিক্ষকদের এমন অভিযোগ দেওয়ার সুযোগ নেই। মাহবুবুর রহমানের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণেই আজ শিক্ষকদের বেতন বন্ধ।
২০২০ সালের জুন থেকে কলেজের ৬০ জন শিক্ষক-কর্মচারী বেতন পাচ্ছেন না। আর কারিগরি বিভাগের ৮ জন ২০২১ সালের মে মাস থেকে বেতন পাচ্ছেন না। হিসাব অনুযায়ী, তাঁরা চার মাসের বেতন পাননি। শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনের এই টাকার পরিমাণ প্রায় ২ কোটি বলে জানান রূপালী ব্যাংক, কালীগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক মো. আবু তুহিন।
কলেজের শিক্ষকেরা জানান, ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পাশে ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মাহতাব উদ্দিন ডিগ্রি কলেজটি। ডিগ্রি, স্নাতক (সম্মান), বিএম শাখা মিলিয়ে বর্তমানে প্রায় ৫ হাজার শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে। শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন ৯৯ জন। ২০১৮ সালে কলেজটি জাতীয়করণ করা হয়। ২০০৮ সালে মাহবুবুর রহমান অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। আর ২০১৪ সালে কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন স্থানীয় সাংসদ আনোয়ারুল আজীম।
একাধিক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করে জানান, ২০১৪ সালের অক্টোবরে অধ্যক্ষ মাহবুবুর রহমান হজ পালন করতে যান। ওই বছরের ৩০ অক্টোবর কলেজ পরিচালনা কমিটির এক সভায় অধ্যক্ষকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। দায়িত্ব দেওয়া হয় উপাধ্যক্ষ আবদুল মজিদ মণ্ডলকে। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎসহ ১৩টি অভিযোগ আনা হয়, যা তদন্ত শেষে মিথ্যা প্রমাণিত হলে ২০১৯ সালের ৭ আগস্ট শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে অধ্যক্ষকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। দায়িত্ব বুঝে না দেওয়ায় একই বছরের ২৩ অক্টোবর উপাধ্যক্ষ আবদুল মজিদ মণ্ডলকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। কারণ দর্শাও নোটিশের জবাব সন্তোষজনক নয় জানিয়ে শিক্ষা অধিদপ্তর একই বছরের ২৭ অক্টোবর উপাধ্যক্ষের স্বাক্ষরে কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা তোলা যাবে না জানিয়ে দেয়। এরপর থেকে তাঁদের বেতন বন্ধ থাকে। অবশ্য ২০২০ সালের জুনে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে অঙ্গীকার করে উপাধ্যক্ষ আবদুল মজিদ স্বাক্ষর দিয়ে এক দফা বেতনের টাকা তোলেন। এরপর আবারও আটকে যায় শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন।
বিষয়টি স্থানীয় সাংসদের সঙ্গে অধ্যক্ষের মতবিরোধ উল্লেখ করে মাধ্যমিক উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল কাদের বলেন, কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও ইউএনও’র যৌথ স্বাক্ষরে বেতন উত্তোলনের অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। এ বিষয়ে তাঁরা তদন্ত করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
কলেজের এক শিক্ষক জানান, পাঁচজনের সংসার, তাঁর আয়েই চলে। ১৪ মাস বেতন বন্ধ, খেয়ে না-খেয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। তিনি বলেন, দোকানিরা আর ধারে পণ্য দিতে চায় না।
কলেজটির বর্তমান পরিচালনা কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাদিয়া জেরিন বলেন, তিনি অল্পদিন এই উপজেলায় যোগদান করেছেন। কলেজের বিষয়টি ইতিমধ্যে তিনি জেনেছেন। শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী আইনগত পদক্ষেপ নেবেন।
আগে একজন সাংসদ তাঁর নির্বাচনী এলাকার সর্বোচ্চ চারটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির সভাপতি হতে পারতেন। ২০১৬ সালে উচ্চআদালতের রায়ে সেই সুযোগটি বাতিল করা হয়। অর্থাৎ এখন আর সাংসদেরা পদাধিকার বলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি হতে পারেন না।