-
বন্ধুর মায়ের অপমানের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে খুন হওয়া দুই যুবকের পরিবারে শোকের মাতম
-
অভিযুক্তদের উপযুক্ত শাস্তির দাবি উভয় পরিবারের:একই কবরস্থানে দুই বন্ধুর পাশাপাশি দাফন
ঘটনাস্থল থেকে ফিরে আহসান আলম-সাথে ছিলেন জুড়ানপুর প্রতিনিধি সাকিল উদ্দিন:
নিহত সজলের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম: চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার ভিমরুল্লাহ গ্রামের সারজেদ আলীর মেয়ে জেসমিন খাতুনের সাথে বছর তিনেক আগে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় সজলের। বিয়ের দেড় বছর পরই তাদের ঘর আলো করে আসে সাফওয়ান বিন সাবিদ রাফিন নামের ফুটফুটে এক পুত্র সন্তান। পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভালোই চলছিল তাদের সুখের সংসার। এরই মাঝে ১৮ মাস আগে সজলের মা জোহরা বেগমের মৃত্যু হয়। মায়ের মৃত্যুর পর সজল তার বাবা আমজাদ হোসেনকে তাদের সংসারে রেখে একত্রিত বসবাস করতে থাকে। বাবা-মায়ের শ্নেহ ভালবাসা আর দাদার আদরে হাটিহাটি পা পা করে রাফিন বড় হতে থাকে। এরই মাঝে ঘটে যায় এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। বন্ধুর মায়ের অপমানের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে প্রাণ দিতে হয় সজলকে। বাবা ডাক শেখার আগেই রাফিন হারায় তার বাবাকে। সংসারের কিছু বুঝে ওঠার আগেই স্বামীকে হারায় জেসমিন খাতুন এবং উপযুক্ত ছেলের অকাল মৃত্যুতে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন আমজাদ হোসেন। মুহুর্তের মধ্যে ঘটে যাওয়া হত্যাকান্ডের ঘটনা একটি পরিবারকে ভাসিয়ে দেয় শোকের সাগরে। শুধু পরিবারই না সজলের মৃত্যুতে এলাকার মানুষের মাঝে বইছে শোক। প্রতিবেশি ও আত্মীয়স্বজনেরা শোকাহত পরিবারকে শান্তনা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও তারা যেন শান্তরনা দেয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার চিৎলা ইউনিয়নের কয়রাডাঙ্গা ফিল্ড পাড়ায় প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে নিহত সজলদের বাড়িতে গেলে এমনই হৃদয়বিদারক দৃশ্য চোখে পড়ে।
আমজাদ হোসেনের চার ছেলে-মেয়ের মধ্যে বড় রুবেল ও ছোট ছেলে সজল। বড়ভাই রুবেলের পাশাপাশি সজলও আলমসাধু চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে তারা থাকেন স্বামীর সংসারে। ছেলে সজল-পুত্রবধু জেসমিন খাতুন ও পুতাছেলে রাফিনকে নিয়ে সুখেই দিন কাটাচ্ছিলেন আমজাদ হোসেন। সেই সুখ তার কপালে সইলোনা। একটি তুচ্ছ ঘটনা সবকিছু উলট-পালট করে ভাসিয়ে দিলো শোকের সাগরে।
সজলের স্ত্রী জেসমিন খাতুন বলেন, মঙ্গলবার বেলা ১২ টার দিকে ভিমরুল্লাহ গ্রামে আমার বাবার বাড়ি থেকে একসাথে কয়রাডাঙ্গায় শ্বশুর বাড়িতে ফিরি। কিছুক্ষণ পরই একটি ভুট্টার ভাড়া মারতে আলমসাধু নিয়ে কয়রাডাঙ্গা মোড়ে চলে যায় তার স্বামী। দুপুরে কিছু না খেয়েই বাড়ি থেকে জীবিকার সন্ধানে বের হয় সজল। এরই মাঝে বেশ ক’একবার মোবাইল ফোনে সজলের সাথে তার যোগাযোগ হয়। বিকেল গড়িয়ে সন্ধা পার হলেও তার স্বামী বাড়িতে না ফেরায় মরেন মধ্যে কিসের যেন এক অজানা আতঙ্ক ভর করে। রাত বাড়ার সাথে সাথে বুকের ভিতর ছটফট করতে থাকে। রাত সাড়ে ৮ টার দিকে ফোন আসে। ছুটে যায় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে।
কান্নাজড়িত কন্ঠে জেসমিন খাতুন বলেন, হাসপাতালে ছুটে গেলেও আমার স্বামীকে জীবিত দেখতে পাইনি। তাঁর নীথর দেহটা হাসপাতালের ট্রলিতে পড়ে থাকে দেখে নিজেকে বুঝ দিতে পারিনি। যারা আমার স্বামীকে হত্যা করেছে তাদের উপযুক্ত শাস্তি হলে মনকে হয়তো কিছুটা বুঝ দিতে পারবো।
আমজাদ হোসেন বলেন, আমার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েছিলাম কিভাবে সংসারকে এগিয়ে নিয়ে যাব এই ভেবে। আমার ছেলে সজল আর পুত্রবধু জেসমিন আমার আমাকে দেখাশোতান দ্বায়িত্ব নেয়। সেই থেকে এখন পর্যন্ত তাদের সংসারেই আছি। তারা আমাকে কখনও কোন কষ্ট দেয়নি। সংসাসের উপার্জনক্ষম উপযুক্ত ছেলেকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন আমজাদ হোসেন। তিনি বলেন, হত্যাকারি যারায় হোক তাদের উপযুক্ত শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
নিহত মামুনের বাবা-মা ও তার পরিবারের আহাজারি: কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়েছিলেন নিহত মামুন অর রশিদ। পড়ালেখার পাশাপাশি চুয়াডাঙ্গা শহরে একটি এনজিওতে চাকরি করতেন। ব্যাক্তিগত জীবনে মামুন অবিবাহিত ছিলেন। নিজের পড়ালেখার খরচের পাশাপাশি বাবা-মায়ের সংসার চালাতেন তিনি। চাকরির পাশাপাশি বাবার কৃষিকাজেও সহযোগীতা করতেন মামুন। পরউপকারি ও মানুষের বিপদাপদে সবসময় তাদের পাশে থাকার কারনে গ্রামের সকলেই মামুনকে অত্যস্ত ভালোবাসতেন। বন্ধুর মায়ের অপমানের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে মঙ্গলবার রাতে খুন হয়েছেন মামুন। ছেলেকে হারিয়ে মনকে কিছুতেই যেন বুঝ দিতে পারছেন না বাবা আব্দুল আজিজ ও মা মমতাজ বেগম। পরিবারের উপার্জনক্ষম সন্তানকে হারিয়ে তারা দিশেহারা ও বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন।
মামুন অর রশিদের বাবা আব্দুল আজিজ বলেন, মঙ্গলবার দুপুরে ধান কাটার কাজে আমাকে সহযোগীতা করার জন্য মামুনকে বলি। বুধবার আমার সাথে থেকে ধান কেটে দেবে বলে জানায়। দুপুরের দিকে তাঁর মোবাইল ফোনে কল আসলে না খেয়ে বাড়ি থেকে বের হয় মামুন। বিকেলে একবার মোবাইলে কথা হয়েছিল মামুনের সাথে। রাতে খবর আসে আমার ছেলেকে ক্ষতবিক্ষত অবন্থায় হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। কারা নাকি তাঁর বুকে চাকু মেরেছে। খবর পেয়ে আর বসে থাকতে পারিনি। কিছুক্ষন পর খবর আসে আমার ছেলে আর নেই। আমার ছেলেকে যারা হত্যা করেছে আমি তাদের উপযুক্ত শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
মামুনের মা মমতাজ বেগম বলেন, আমার মামুন গরুর মাংস খুব পছন্দ করতো। মঙ্গলবার আমাকে গরুর মাংস রান্না করতে বলেছিল। দুপুরে আমি গরুর মাংস রান্না করেছিলাম। দুপুরে হঠাৎ মোবাইলে কল আসলে তাড়াতাড়ি বাইরে বের হয়ে যায় মামুন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে সন্ধা নামার কিছু পরই খবর আসে আমার ছেলেকে কারা যেন চাকু মেরেছ। এর অল্প কিছুক্ষণ পর খবর আসে আমার ছেলে আর নেই। তিনি আরও বলেন, আমার ছেলেকে যারা খুন করেছে তাদেরকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মারার দাবি জানাচ্ছি।
এদিকে, গতকাল বুধবার দুপুরে ময়নাতদন্ত শেষে সজল ও মামুনের মরদেহ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। দু’জনের লাশ দিয়ে উভয় পরিবারের লোকজন তাদের বাড়িতে পৌছালে তাদেরকে শেষবারের মতো দেখতে এলাকার হাজারো মানুষের ঢল নামে। এলাকায় শোকের ছাঁয়া নেমে আসে। বাদ মাগরিব কয়রাডাঙ্গা নান্টু স্টেডিয়ামে জানাযা শেষে এলাকার কবরস্থানে পাশাপাশি দুই বন্ধুকে দাফণ করা হয়।
অপরদিকে, ভালাইপুর বাজারে আশরাফুল বস্ত্রালয় অ্যান্ড গর্মেন্টেসে ছিটকাপড় কিনতে যাওয়া ভালাইপুর নতুনপাড়া গ্রামের ছামেনা খাতুনের সাথে কথা বলতে বুধবার দুপুরে তার বাড়িতে গেলে তিনি বলেন, মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ৩ টার দিকে আশরাফুল বস্ত্রালয় অ্যান্ড গর্মেন্টেসে ছিটকাপড় কিনতে যায়। ছিটকাপড় পছন্দ হওয়ার পর দোকানের কর্মচারী রিয়ন প্রতি গজ কাপড়ের দাম চায় ৮৫ টাকা। আমি ৮০ টাকা করে দিতে চাইলে রিয়ন প্রথমে দিতে রাজি হয়। কাপড় কাটার পর কিছুই কম নেয়া হবে না বলে রিয়ন সাফ জানিয়ে দেয়। এ নিয়ে রিয়নের সাথে আমার কথাকাটাকাটি হলে রিয়ন স্কেল দিয়ে আমাকে মারতে যায় তাদের দোকান থেকে আমাকে বের করে দেয়। বাড়িতে ফিরে বিষয়টি আমার ছেলে টিপু সুলতানকে জানায়। টিপু সুলতান কাপড়ের দোকানে গিয়ে দোকান মালিকের উপস্থিতিতে রিয়ন মাফ চাইলে বিষয়টি মিমাংশা হয়ে যায়।
এদিকে, বন্ধুর মাকে অপমান করেছে বিষয়টি জানতে পেরে টিপু সুলতানের বন্ধু সজল ও মামুন তাদের বাড়িতে ছুটে যায়। তারা বেশকিছু বন্ধু মিলে সন্ধার পর রিয়নের বাড়িতে যায়। ছামেনা বেগমের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে বলে তারা রিয়নকে মোটরসাইকেল যোগে নিয়ে যাওয়ার সময় হুচুকপাড়া-ভালাইপুর সড়কের প্লাস পয়েন্ট নামক এক দোকানের সামনে পৌছালে হুচুকপাড়ার আলাউদ্দিনের ছেলে আকাশ, মুছা করিমের ছেলে শান্তি, ওসমান গনির ছেলে সানোয়ার হোসেন ও জাহাঙ্গীরসহ ১০/১২ জন তাদের মোটরসাইকেলের গতিরোধ করে। এ সময় তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তারা সজল ও মামুনকে আঘাত করতে থাকে। এতে সজলের পেটে ও মামুনরে বুকে আঘাত লাগে। তাদেরকে উদ্ধার করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নিলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দু’জনই মারা যায়।
পশ্চিমাঞ্চল/পল্টন…………….