বিশেষ প্রতিনিধি:সারাদেশে অব্যাহতভাবে চলা ধর্ষণ ও নারী নিপীড়নের বিচারের দাবিতে শুক্রবার বিকেল তিনটা থেকে রাজধানীর শাহবাগ এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেন বামপন্থী সংগঠনগুলো। বামপন্থী ও নারী অধিকার রক্ষার সংগঠন ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে গান, কবিতা সমাবেশের মধ্য দিয়ে পালিত হয়েছে এ বিক্ষোভ কর্মসূচি।
একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। রাজধানীর শাহবাগ এলাকায় একইসময়ে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের গণজমায়েত করার কথা থাকলেও তারা সমাবেশ করে রাজধানীর প্রেসক্লাব এলাকায়। এদিকে দ্বিতীয়দিনের মতো নুর ও মামুনদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলার বাদী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রী আমরণ অনশন অব্যাহত রেখেছে।
‘ধর্ষণ ও বিচারহীনতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’ লেখা ব্যানারে এই মহাসমাবেশে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ‘চিৎকার করো মেয়ে, দেখি কত দূর গলা যায়, আমাদের শুধু মোমবাতি হাতে নীরব থাকার দায়’ গণসংগীতের মধ্য দিয়ে মহাসমাবেশ শুরু হয়। এরপর গণসংগীত পরিবেশন, আবৃত্তি ও পথনাটক পরিবেশন করা হয়।
বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছন্দে ছন্দে বিক্ষোভকারীরা স্লোগান দিয়ে প্রতিবাদ করেন। ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলায় ধর্ষকদের ঠাঁই নাই’, ‘এসো ভাই এসো বোন, গড়ে তুলি আন্দোলন‘, ‘প্রীতিলতার বাংলাদেশে, ধর্ষকদের ঠাঁই নাই’, ‘ধর্ষকদের কারখানা, ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’, ‘পাহাড় কিংবা সমতলে, লড়াই হবে সমানতালে’ স্লোগানে বিক্ষোভ করছেন।
বিক্ষোভকারীরা বলেন, ধর্ষণের মনস্তত্ত্ব সমাজ থেকে দূর করতে রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলনও গড়ে তুলতে হবে। সামাজিকভাবে ধর্ষকদের ও ধর্ষকের পৃষ্ঠপোষকদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। শাহবাগের বিক্ষোভে দাবি আদায়ে ধারাবাহিক কর্মসূচি ঘোষণা করে ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক অনিক রায় বলেন, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবিতে ধর্ষণ ও নির্যাতন বিরোধী বাংলাদেশ প্ল্যাটফর্মের ব্যানারে বাম ধারার ছাত্র সংগঠনগুলো প্রতিদিন বিকাল ৪টা থেকে শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে অবস্থান নেয়া হবে।
মহাসমাবেশ থেকে ৯ দাবি
সমাবেশ থেকে ধর্ষণ ও নিপীড়ন বন্ধে ৯ দফা দাবি উত্থাপন করেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন প্রিন্স।
১. সারা দেশে অব্যাহত ধর্ষণ-নারীর প্রতি সহিংসতার সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ধর্ষণ, নিপীড়ন বন্ধ ও বিচারে ‘ব্যর্থ’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অবিলম্বে অপসারণ করতে হবে।
২. পাহাড়-সমতলে আদিবাসী নারীদের ওপর সামরিক-বেসামরিক সব ধরনের যৌন ও সামাজিক নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে।
৩. হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে নারী নির্যাতন বিরোধী সেল কার্যকর করতে হবে। সিডো সনদে স্বাক্ষর ও তার পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক সব আইন ও প্রথা বিলোপ করতে হবে।
৪. ধর্মীয়সহ সব ধরনের সভা-সমাবেশে নারীবিরোধী বক্তব্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। সাহিত্য, নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপনে নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন বন্ধ করতে হবে। পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণে বিটিসিএলের কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক চর্চায় সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে।
৫. তদন্তকালীন সময়ে ভিকটিমকে মানসিক নিপীড়ন-হয়রানি বন্ধ করতে হবে। ভিকটিমের আইনগত ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৬. অপরাধ বিজ্ঞান ও জেন্ডার বিশেষজ্ঞদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়িয়ে অনিষ্পন্ন সব মামলা দ্রুত নিষ্পন্ন করতে হবে।
৭. ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইন ১৮৭২-১৫৫ (৪) ধারা বিলোপ করতে হবে এবং মামলার ডিএনএ আইনকে সাক্ষ্য প্রমাণের ক্ষেত্রে কার্যকর করতে হবে।
৮. পাঠ্যপুস্তকে নারীর প্রতি অবমাননা ও বৈষম্যমূলক যে কোনো প্রবন্ধ, নিবন্ধ, পরিচ্ছেদ, ছবি, নির্দেশনা ও শব্দ চয়ন পরিহার করতে হবে।
৯. গ্রামীণ সালিশের মাধ্যমে ধর্ষণের অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে।
ধারাবাহিক কর্মসূচি ঘোষণা ঘোষণা অনুযায়ী ১১ অক্টোবর ধর্ষণবিরোধী আলোকচিত্র প্রদর্শনী, ১২ অক্টোবর সাংস্কৃতিক সমাবেশ, ১৩ অক্টোবর চলচ্চিত্র উৎসব, ১৪ অক্টোবর নারী সমাবেশ ও ১৫ অক্টোবর সারা ঢাকায় ধর্ষণবিরোধী সাইকেল র্যালির কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে।
ছাত্রলীগের বিক্ষোভ
রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে আয়োজিত সমাবেশে ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় বলেন, এই বাংলাদেশে কিছু কুলাঙ্গার ধর্ষণের মতো কাজ করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আজ ১৮ দিন ধরে বিচারের দাবিতে নিরবে নিভৃতে কাঁদছে। প্রশাসনের প্রতি আমাদের অনুরোধ থাকবে, অনতিবিলম্বে দ্রুত সময়ের মধ্যে তথাকথিত ছাত্র অধিকার পরিষদের কুলাঙ্গারদের গ্রেফতার করুন।
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশ থেকে ধর্ষণ নামক অভিশাপকে মুক্ত করতে হলে সবার নিজের জায়গা থেকে কাজ করতে হবে। ছাত্রলীগের কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যদি আর একটি বোন লাঞ্চিত হয়, একটি বোনকে উত্যক্ত করা হয় উত্যক্তকারীকে আপনারা নিজের জায়গা থেকে প্রতিহত করুন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস বলেন, বাংলাদেশের মেধাবী তরুণরা সত্য ইতিহাসকে ত্যাগ করেছে। ছাত্রলীগের দুর্বার আন্দোলন, দুর্বার সংগ্রামকে ভুলতে বসেছে। নুরুরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর মাধ্যমে আন্দোলন জমাতে চাইতে।
ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, পঁচাত্তরের খুনিরা ইনডেমনিটি পায়নি, ফাতেমা আক্তারের খুনিরাও ধর্ষণের ঘটনায় ইনডেমনিটি পাবে না। বাংলাদেশে গত কয়েকদিন ধরে ন্যক্কারজনক কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে এ সবের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী জিরো টলারেন্সের অবস্থানে রয়েছে।
নুরের অভিযোগ প্রেসক্লাব এলাকায় গণজমায়েতে আন্দোলন দমাতে ঢাবি ক্যাম্পাস দখলে নিয়েছে বলে অভিযোগ করেন ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর। তিনি বলেন, আজকে যখন এসব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ছাত্র-জনতা অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ শুরু করেছে তখন ক্ষমতাসীন দল সারাদেশ থেকে দুর্বৃত্তদের এনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরপুর করে রেখেছে। ধর্ষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে তা দমাতে পলাশী, লালবাগসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় দখলে নিয়েছে