তানজীর ফয়সাল, দামুড়হুদা থেকে: দামুড়হুদা উপজেলায় করোনা সংকট মোকাবিলা ও সংক্রমণ প্রতিরোধে নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জনস্বার্থে পেশাদ্বায়িত্বের সাথে নিরলসভাবে কাজ করছেন প্রশাসনের ৪ কর্মকর্তা। এরই মধ্যে নিজ দ্বায়িত্ব পালনে সচেষ্ট ভূমিকা রেখে চলা দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর পঃ পঃ কর্মকর্তা ডাঃ আবু হেনা মোহাম্মদ জামাল শুভ গতকাল বুধবার করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। যে কর্মকর্তা রোগীকে আপন করে করোনা নামক ভাইরাসের সংক্রমণ হওয়ার প্রথম থেকেই জনসাধারণের কল্যাণে ছুটেছেন উপজেলার এ প্রান্তে থেকে অপর প্রান্তে। যার নেতৃত্বে সুস্থ হয়েছে করেনাসহ অন্যআন্য রোগী সাধারণ, আজকে তার এ আক্রান্তের খবর ছড়িয়ে পড়তে অনেকেই হয়েছেন ব্যাথীত। ডাঃ আবু হেনা মোহাম্মদ জামাল শুভ করোনা সংক্রমণ হয়ে নিজ বাড়ীতে রয়েছেন চিকিৎসাধীন। এ কর্মকর্তা সুস্থতার জন্য উপজেলা বাসীর নিকট দো’আ কামনা করেছেন। ঝড়, বৃষ্টি উপেক্ষা করে করোনার ঝুঁকি মাথায় নিয়ে দিনরাত ছুটে চলা চার যোদ্ধা।
চার কর্মকর্তারা হলেন, দামুড়হুদা উপজেলা নির্বাহী অফিসার দিলারা রহমান, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিষ্ট্রেট সুদীপ্ত কুমার সিংহ, দামুড়হুদা মডেল থানা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ আব্দুল খালেক ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর পঃ পঃ কর্মকর্তা ডাঃ আবু হেনা মোহাম্মদ জামাল শুভ।
কিবা দিন কিবা রাত কারো ঘরে খাবার প্রযোজন, লকডাউন কৃত বাড়ীর সদস্যরা মানছেন না নির্দেশনা। এসময় ছুটে চলেছেন করোনা আক্রান্ত রোগীর বাড়ী, বুঝিয়ে করেছেন সচেতন। এরপর মোবাইল ফোনে খবর চায়ের দোকান খোলা, মাচায় বসে তাস খেলা, আড্ডা দেওয়া এমন অভিযোগ পেলেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সকল মায়া উপেক্ষা করে প্রত্যেকে ছুটে চলছে এক প্রান্তে হতে অপর প্রান্তে।
উপজেলায় করোনা প্রতিরোধে এ চার কর্মকর্তা বিভিন্ন সময়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করণে মাইকিং করে লকডাউন বাস্তবায়নে রেখে চলেছে কঠোর ভূমিকা। করোনা কালে সংকট মোকাবিলা সকলকে স্বাস্থ্য বিধি মেনে ঘরে থাকতে আহবান জানিয়ে করে চলেছেন সচেতন। কর্মহীন মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে সরকারি খাদ্য সহায়তা। এরই মাঝে মোবাইল করলে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে খাদ্য সহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী। উপজেলা বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিয়ত বিতরণ করা হচ্ছে মাস্ক। প্রচারণা কালে বারং বার বলা হচ্ছে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলুন, নিজে সুস্থ থাকুন, পরিবারের সকল প্রিয় মানুষ গুলোকে নিরাপদে রাখুন।
মহামারী করোনা সংকট মোকাবিলা ও সংক্রমণ প্রতিরোধে যার ভুমি ছিলো আজ যিনি নিজেই আক্রান্ত উপজেলা স্বাস্থ্য পঃ পঃ কর্মকর্তা ডা. আবু হেনা মোহাম্মদ জামাল শুভ’র সাথে কথা বললে তিনি বলেন, জনসাধারণকে আরও বেশী বেশী সচেতন হতে হবে। নয়তো আগামীতে আমাদের সকলকে ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে। সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়েই চলেছে। আমরা নিরালসভাবে ঝুকি জেনেও সংসারের প্রিয় মানুষ গুলোকে ছেড়ে কাজ করে চলছি। আমাদের কাছে দিন রাত সমান। বর্তমান এমন একটা সময়ে দাঁড়িয়েছে রোগীর কাছে আমরাই আপন হয়ে দাঁড়িয়েছি। সেজন্য আমরাও চাই রোগী সাধারণকে সর্বোচ্চ সেবা দিয়েছি। করোনার ভয়াবহতাই আজ আমি নিজেও আক্রান্ত হয়েছি।
জেলা সিভিল সার্জনের পরামর্শ ও সকলের সার্বিক সহযোগিতায় করোনা মোকাবেলার জন্য আমর হাসপাতালের চিকিৎসক, স্বাস্থ্য কর্মীসহ প্রতিটি সদস্য নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। খবর আসা মাত্রই স্বাস্থ্য কর্মীরা রোগীর বাড়ীতে গিয়ে করোনার নমুনা সংগ্রহ করাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।
আমার হাসপাতালে আল্লাহর রহমতে অক্সিজেনের কোন সংকট নেই,আশা করি তা হবে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞ প্রকাশ করতে চায় সে সকল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে যারা এ সংকট মোকাবিলার মুহূর্তে রোগী সাধারণের কথা মাথায় রেখে অক্সিজেনসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকরণ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন তাদের প্রতি। আল্লাহ আমাদের সকালকে সুস্থতা দান করুক।
জনসাধারণের উদ্দেশ্য করে এ কর্মকর্তা বলেন, আপনারা অপ্রয়োজনে বাইরে ঘোরাঘুরি করবেন না। ভাইরাসটির সংক্রমণে মারাত্মক রুপ ধারণ করার ফলে সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছেন। সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের দেওয়া সকল নির্দেশনা সঠিকভাবে পালন করুন। নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করুন। পরিবারের প্রিয় মানুষ গুলোকে সময় দিন। সর্বোপরি সরকারী বিধিনিষেধ পালনে প্রশাসনকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করে নিজের সুস্থতার জন্য সকলের নিকট দোয়া কামনা করেন।
দামুড়হুদা মডেল থানার চৌকস অফিসার ইনচার্জ আঃ খালেক সাথে কথা বললে তিনি বলেন, “পুলিশি জনতা, জনতায় পুলিশ ” স্লোগান কে বুকে ধারণ করে চুয়াডাঙ্গা জেলা পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম স্যারের নির্দেশনায় দামুড়হুদা মডেল থানার অন্তর্ভুক্ত বাজার, রাস্তার মোড়সহ গ্রামে প্রতিটি পুলিশ সদস্য নিরলসভাবে প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন মডেল থানা পুলিশের প্রতিটি সদস্য। করোনা ভাইরাসকে পরাজিত করার জন্য জেলা পুলিশের পক্ষে থেকে লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে, জনস্বার্থ প্রচারণা চলমান রয়েছে। ইতিমধ্যে জেলা পুলিশের উদ্যোগে খাদ্য বিতরণসহ জনগণকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে পুলিশ বাহিনী। সর্বত্র জনসাধারণের সেবা করার জন্য আমরা বাহিরে আছি। আপনাদের মাধ্যমে সর্বসাধারণের উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে সকলকে ঘরে থেকে আমাদের সহযোগিতা করুন। অপ্রয়োজনে আপনারা ঘরের বাইরে বার হবেন না, মাস্ক পরিধান করা সহ সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের দেওয়া সকল নির্দেশনা সঠিকভাবে পালন করুন। নিজে সুস্থ থাকুন, পরিবারের প্রিয় মানুষ গুলোকে সুস্থ রাখুন। আপনাদের সহযোগিতার হাত ধরে সংক্রমণ প্রতিরোধ হবে বলে আশাবাদী। যতক্ষণ জীবন থাকবে ততক্ষণ জনগণকে এই দুর্যোগের সময়ে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে বলে এই কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিষ্ট্রেট সুদীপ্ত কুমার সিংহ আমাদের প্রতিবেদককে বলেন, জনগণের পাশে থেকে সেবা করার সুযোগ এসেছে। করোনার ভয়ে এখন আমাদের বসে থাকলে চলবে না। জনগণকে নিরাপত্তা দিতে হবে। সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়েই জেলা প্রশাসক স্যারের নির্দেশ ও দামুড়হুদা উপজেলা নির্বাহী অফিসার এর নেতৃত্বে মাঠে কাজ করছি। যতক্ষণ জীবন আছে ততক্ষণ জনগনকে করোনা মোকাবেলায় সেবা দিয়ে যাবো।
আমাদের খুব খারাপ লাগে যখন পেটের দায়ে বের হওয়া মানুষগুলোকে বল প্রয়োগ করে বাসায় পাঠিয়ে দেই, যখন পেশাদারিত্বের কারণে বা দায়িত্ব পালনের জন্য একজন পথচারী বা আগন্তুকের সাথে কড়া ভাষায় কথা বলতে হয় পরমুহূর্তেই আমাদের কষ্ট লাগে।
দিনশেষে আমরা মানুষ, আমরা এদেশের আলো বাতাসে বড় হওয়া নাগরিক। তাই পেশাদারিত্বের কারণেই হোক বা সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্যই হোক আমাদের কঠোরতা আমাদেরকেই ব্যথিত করে।
মনে প্রাণে বিশ্বাস করি যখন কঠোরতা দেখানোর কথা তখন কঠোরতা না দেখানো, যখন নমনীয়তা দেখানোর কথা তখন নমনীয়তা না দেখানো দায়িত্ব অবহেলার শামিল। তাই সকল ভয়ভীতি, ঝুকিকে অবজ্ঞা করেই নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের প্রতিজ্ঞা করেই এই পেশায় আসা।
এসময় জনসাধারণের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন আমরা সকলে নিজ নিজ অবস্থান থেকে যদি একটু সচেতন হই। সরকারের দেওয়া সকল নির্দেশনা মেন চলাচল করি তাহলে হইতো এই মহামারি সংকট মোকাবিলা করতে সহজ হবে। আসুন আমরা এই অদৃশ্য ভয়াবহ করোনা নামক ভাইরাসকে সন্মানিত ভাবে প্রতিরোধ করতে ভূমিকা রাখি। সকলে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলাচল করুন, নিজে সুস্থ থাকুন, পরিবারকে সুস্থ রাখুন।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার দিলারা রহমান দৈনিক পশ্চিমাঞ্চলেকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, সংবাদকর্মী, স্বাস্থ বিভাগ এবং চয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার স্যারের দিক নির্দেশনায় উপজেলাকে করোনা মোকাবেলায় ঢেলে সাজানো হয়েছে। সকলের সহযোগিতা ও সমন্বয়ে করোনা ভাইরাসকে মোকাবেলার জন্য কাজ করা হচ্ছে। উপজেলা প্রতিটি ইউনিয়ন ও উপজেলার দর্শনা পৌরসভার এলাকা সমূহে জনগণকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার জন্য সচেতনতা সৃষ্টি করা হয়েছে। করোনায় আক্রান্তদের বাড়ী বাড়ী খাবার পৌঁছে দেওয়া, ঔষধপত্র দেওয়া, লকডাউনে থাকা পরিবারের সদস্যদের খাবার বিতরণ, করোনায় আক্রান্তদের জন্য আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা, শিশু খাদ্য বিতরণ, কর্মহীন ও দরিদ্রদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ, নিয়মিত বাজার মনিটরিং করা, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা, নিয়মিত অফিসের কাজ করাসহ করোনার মত মহামারী দুর্যোগের সময় ঝুঁকি মাথায় নিয়ে দিনরাত কাজ করা হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি জনগণের পাশে থেকে সর্বোচ্চ সেবা ও সহযোগিতা করার জন্য। করোনা সংকট মোকাবিলায় এমন পরিস্থিতিতে হতদরিদ্র, কর্মজীবী-কর্মহীন হয়ে পড়েছে সে সকল পরিবার যাতে সরকারি খাদ্য সহায়তার বাহিরে না থাকে সে বিষয়টি কঠোর ভাবে দেখা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে কোন পরিবার যাতে না খেয়ে অভুক্ত থাকেন। বর্তমানে আমাদের প্রত্যেকের জীবনের ঝুঁকি নিরসনে সঠিক উপায় হলো আল্লাহর কাছে মুক্তি চাওয়া এবং সরকারী নিয়ম মেনে লকডাউন প্রতিপালন করা।
বিশ্বের এ ক্রান্তিকালে মোবাইল কোর্ট করে জরিমানা করা কিন্তুু একমাত্র লক্ষ্য নয়। আমরা যারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করছি আমাদের ঘরেও রয়েছে শিশু সন্তান, বৃদ্ধ বাবা-মা। তাদের আকুতিকে পিছনে ফেলে আমরা আমাদের জীবনের ঝুঁকি উপেক্ষা করে সরকারি বিধি বাস্তবায়নে কাজ করছি। আপনাদের নিরাপদ জীবন নিশ্চিতকরণে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেও উপজেলার এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ছুটে চলেছি। মাঠে টহলে নেমেছে সশস্ত্র বাহিনী। সকলের সকল প্রচেষ্টা, শ্রম, ত্যাগ সব ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি সাধারণ মানুষ সর্বাত্মক সহোযোগিতা না করে।
আপনাদের লেখেনির মাধ্যমে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বসাধারণের কাছে অনুরোধ করছি আপনারা সরকারী আইন মেনে লকডাউন বাস্তবায়নে আমাদের সহযোগিতা করুন। স্বাস্হ্যবিধি মেনে চলুন। নিজে সুস্হ থাকুন, অপরকে নিরাপদ রাখুন।