বিশেষ প্রতিনিধি: জেলার গাছিরা আগাম খেজুর গাছ তুলতে শুরু করেছেন। শীত আসতে না আসতে চুয়াডাঙ্গা জেলার গাছিরা আগাম খেজুর গাছ পরিচর্চায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। কে কত আগে, খেজুর রস সংগ্রহ করতে পারে, সেই প্রতিযোগিতায় চলছে চুয়াডাঙ্গার গাছিদের মাঝে। খেজুর গাছ থেকে বিশেষভাবে রস সংগ্রহ করতে পারদর্শী তাদেরকে গাছি বলা হয়।। গাছিরা হাতে দা নিয়ে ও কোমরে ডোঙ্গা বেঁধে নিপুণ হাতে গাছ চাছাছোলা করছেন।
চুয়াডাঙ্গা জেলার প্রতিটি মাঠের ক্ষেতের আইলে, রাস্তার পাশে, পুকুর পাড়ে-অযত্নে-অবহেলায় বেড়ে ওঠা খেজুরের গাছ জেলার অর্থনীতিতে আশীর্বাদ। শীত মৌসুমে রস-গুড় উৎপাদন করে প্রায় ৫ থেকে ৬ মাস স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে জেলার কয়েক হাজার পরিবার।
চুয়াডাঙ্গায় চলে এসেছে শীতের আগমণি বার্তা। সকাল ও সন্ধ্যায় হালকা শীত অনুভূত হচ্ছে। সকালে হালকা কুয়াশায় ঢেকে পড়ছে চারদিক। তাই শিশির ফোটায় জানান দিচ্ছে শীতের আগমণী বার্তা। শীতের আমেজের শুরুতে চুয়াডাঙ্গার গাছিরা রস সংগ্রহের জন্য গাছ প্রস্ততের কাজ শুরু করেছে। প্রতিদিন সকালে হালকা শীত উপেক্ষা করে গাছিরা তাদের গাছ কাটার যন্ত্র নিয়ে গাছ পরিচর্যা করতে ব্যস্ত সময় পার করছে।
জানা গেছে, এবার গাছ কাটার যন্ত্রের দাম বেড়েছে। প্রতিদিন গাছিরা ৬০ থেকে ৭০টি গাছ কেটে প্রস্তত করছে। এতে তাদের দৈনিক পারশ্রমিক পাচ্ছে ৮০০ টাকা। বাজারে সবজিনিসের মূল্য বৃদ্ধির কারণে চাহিদা মতো গাছিদের পারশ্রমিক মিলছে না বলছে গাছিরা। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত গাছ কাটছে এবার গাছিরা। গাছ প্রস্তত করার পর শুরু করা হবে রস সংগ্রহ। এরপর তৈরি হবে উৎকৃষ্ট মানের গুড় ও পাটালি। এই জেলার গুড় ও পাটালি চুয়াডাঙ্গাসহ সারাদেশের কয়েকটি জেলায় তা সরবরাহ করা হয়। প্রতিবারের মতো এই জেলার গুড় ও পাটালি সুনাম আছে । ভেজাল ও চিনিমুক্ত গুড় ও পাটালি তৈরি করে তা বাজারে বিক্রি করে তাদের অর্থনেতিক অবস্থা পরিবর্তন করে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এবার চুয়াডাঙ্গা সদরে ৯৮ হাজার ৫০০ টি গাছ। আলমডাঙ্গায় ৪৫ হাজার ৫১০টি গাছ, দামুড়হুদায় ৮১ হাজার ৩০০টি গাছ, জীবননগরে ৪৬ হাজার ৬৫০টি গাছ। মোট এবার খেজুর গাছের সংখ্যা ২ লাখ ৭১ হাজার ৯৬০টি গাছ প্রস্তত করা হচ্ছে। এতে এবার গুড়ের লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে ২ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন । এই লক্ষমাত্রা গুড়ের বিক্রির পরিমাণ ধরা হয়েছে ৩৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। প্রতিবার এই গাছ প্রস্ততে কর্মসংস্থান হয়ে প্রায় ৩০ হাজার কৃষকের।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা বেলগাছি গ্রামের কৃষক আরিফ হোসেন জানান, চুয়াডাঙ্গায় শীতের আমেজ শুরু হয়েছে। তাই রস সংগ্রহের জন্য খেজুর গাছ কেটে প্রস্তত করা হচ্ছে। তারপর তৈরি হবে গুড়। এখানকার গুড়ের সুনাম আছে। প্রতিবার এই গাছ কেটে আমরা আমাদের অর্থনেতিক চাহিদা মিটায়। গুড়-পাটালি বিক্রি করা হয় বাজারে। আর কয়দিন পর গাছে গাছে মাটির ভাড় বেধে দেওয়া হবে রস সংগ্রহের জন্য।
অপর কৃষক আজগর আলি বলেন, এখন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গাছ কেটে প্রস্তত করা হচ্ছে। প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০টি গাছ কেটে প্রস্তত করছি। দৈনিক পারশ্রমিক পাচ্ছি ৮০০ টাকা। এতে কিছুই হচ্ছে না। সবজিনিসের মূল্য বৃদ্ধির কারণে চাহিদা মতো পারিশ্রমিক মিলছে না। গাছ কাটার যন্ত্রের দাম বেড়েছে। গাছ কাটার পারিশ্রমিক মূল্য আরও বাড়ালে ভালো হতো।
দামুড়হুদা উপজেলার বাঘাডাঙ্গা গ্রামের শাহাদত হোসেন জানান, চলতি মৌসুমে ২০০ গাছ থেকে খেজুরের রস আহরণ করবেন। খেজুর গাছের রস, গুড়-পাটালি বিক্রয় করে করে খরচ বাদে প্রায় ১ লাখ টাকা লাভের আশা করছি।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সরোজগঞ্জ বাজার উন্নয়ন কমিটির সভাপতি আলী আহম্মেদ হাসানুজ্জামান মানিক বলেন, উপজেলায় এখনো বেশকিছু খেজুরগাছ রয়েছে। ইতোমধ্যে গাছিরা গাছ প্রস্তুত করা শুরু করেছেন। খেজুরের গাছ ও গাছির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। আগের মতো খেজুর গাছও নেই, নেই দক্ষ গাছি কিংবা গুড়-পাটালি তৈরির কারিগর। অনেকে বেড়িবাঁধে খেজুরগাছ লাগাচ্ছেন। অন্যান্য গাছের মতো খেজুরগাছ ও সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। খেজুর গুড় শিশুর মেধা বিকাশে সহায়তা করে। খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ করা থেকে গুড় তৈরি পর্যন্ত একটি শিল্প। যা আজ বিলুপ্তির পথে।
চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক বিভাস চন্দ্র সাহা বলেন, জেলাজুড়ে খেজুরের রস আহরণের জন্য গাছিরা আগাম খেজুর গাছ গুলো প্রস্তত করছে। সঠিক পদ্ধতিতে, স্বাস্থ্য সম্মত উপায়ে যেন রস-গুড় উৎপাদন করে গাছিরা-এ জন্য কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে সব ধরণের সহযোগিতা করা হয়।
তিনি আরো জানান, ভোক্তারা যাতে স্বাস্থ্য সম্মত উপায়ে প্রস্তুত খেজুরের রস-গুড় পেতে পারে এজন্য কাজ করে থাকে চুয়াডাঙ্গা কৃষি বিভাগ। মৌসুমে প্রতিটি গাছ থেকে গড়ে ১০ কেজি গুড় পাওয়া যায়। সে হিসাবে চলতি মৌসুমে ২ লাখ ৭১ হাজার ৯৬০টির মতো খেজুরগাছ থেকে গড়ে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার মেট্রিক টন গুড় উৎপাদিত হবে। এছাড়া গাছিরা খেজুর রস-গুড়ের বিভিন্ন ধরণের পিঠা ও মিষ্টান্ন তৈরি করে নিকটস্থ বাজারে বিক্রয় করে আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে থাকে।